প্রবাস জীবন আমাকে দায়িত্ব নিতে শিখিয়েছে।



গল্পের নাম নীল জ্যাকেটঃ- অগ্রহায়ণের শেষের দিকে বাংলাদেশে শীতের আগমনী বার্তা দরজায় কড়া নাড়ছে।সকালে ঘাসের উপর সূর্য্যের আলোতে শিশির বিন্দু চকচক করে। রৌদ্রজ্বল দিন,সন্ধ্যায় হালকা কুয়াশা নামে।মাঠে মাঠে পাঁকা ধানেভরা।কৃষক কাঁচিতে শান দিয়ে প্রস্তুত হচ্ছে ধান কাঁটতে। নতুন ফসল ঘরে তুলে বিক্রি করে ছেলেমেয়েদের জন্য শীতের জামা কাপড় কিনবে।

আমি এক দরিদ্র  কৃষক পরিবারের ছেলে সদ্য এস এস সি পাস করে কলেজে ভর্তি হলাম।কলেজে আমার সাথে বেশ কিছু বড়লোকের ছেলেদের সাথে বন্ধুত্ব হলো।তাদের সাথে আড্ডা গালগল্পে সারাক্ষণ মেতে থাকি।বড়লোক পরিবারের আয়েসি জীবন যাপন গল্প শুনে আমি দরিদ্র কৃষক পরিবারের পরিচয় গোপন করে তাদের সাথে তালমিলিয়ে আয়েসি গল্প করি।সেইদিন বন্ধুদের বলি কাল আমার বোনের জন্মদিন ছিল বাড়িতে বিশাল পার্টি হয়েছে কতলোক আসলো।সবাই দামি দামি গিফট দিলো আমার চাচা দুবাই থেকে এক খেলনা পুতুল পাঠালো,ভুটাম দাবালে গানের সাথে নাচ করে,আবার আরেক দাবে হাসে, কান্না করে, তা নিয়ে যা মজা হলো।

কই আমাদের তো দাওয়াত দাওনি?

আরে দাওয়াত দেয়নি কি হয়েছে তোমাদের কে নিয়ে স্পেশাল পার্টি দেবো।

থাম,থাম তুর কাছে অনেক পার্টি বাকি আছে।

বড়লোক বন্ধুরা যখন বাবা এই গাড়ি কিনেছে,শহরে বিলাসবহুল আবাসিকে বাড়ি করছে, তাদের চাচা,খালার বিয়ের আয়োজন, ঈদ,উৎসব নিয়ে বিলাসী গল্পকরে তখন আমি,বানিয়ে গল্প বলে নিজের মুখ বড় করি।তাদের সামনে এইসব ছাপা গল্প করে নিজেকে সাময়িক বড়লোক পরিবারের সন্তান হিশেবে উপস্থাপন করতাম,সারাক্ষণ কৃষকের ছেলে বলে আমার ভিতরে একটা  দুঃখবোধ কাজ করতো।দরিদ্র অভাবের মাঝে বড় হয়েছি।অভাব অনটন ভালো লাগে না মিথ্যা গল্পের নায়ক বানিয়ে নিজে সাময়িক সুখি হওয়া যায় তাতে তৃপ্তি পাওয়া যায় না।

শীত আসি আসি করতেছে বন্ধুবান্ধবদের সবার শীতের কাপড়  কিনার ধুম পড়েছে যে যার মতো পছন্দের দেশে বিদেশী ব্রান্ডের শীতের কাপড় কিনছে, জ্যাকেট,স্যুট,পুলহাতা গেঞ্জি বাহারি রংয়ের স্যুয়েটার আরো হরেক রকমের পোশাক।এর মাঝে নীল রংয়ের চামড়ার মাঝখানে সেইন পাশে দুইটি দোরা কাটা পক্যেট এই জ্যাকেট এর বেশ প্রচলন সবাই নিতেছে।আমার বন্ধুরা বেশ কয়জনে নিলো।তারা পরদিন গায়ে দিয়ে কলেজে এলো বাকি বন্ধুরা দেখে দোকানে ছুটলো,সবার হয়েগেল বাকি শুধু আমার,বন্ধুরা আমাকে একটা জ্যাকেট নিতে বলে।সবাই মিলে একটা গ্রুপ ফটোশেসন করবে।

আমি বন্ধুদের বলি আরে এইটা কেমন কথা তোমরা সবাই নিলে আমি নিবনা এইটা কখনও হয়, কোন ব্যাপার না নিয়ে নিব।কথাটা ওখানে যত সহজে বলেছি কিন্তু ভিতরে একটা ধাক্কা লাগে।

বিকালে কলেজ থেকে ফিরার পথে দোকানে যায়,ভাই নীল জ্যাকেট দিন।হাতে নিয়ে ছুঁয়ে দেখে পিটিং রুমে গায়ে দিয়ে আয়নায় দেখি,খুব সুন্দর দেখাচ্ছে গায়ের সাথে পাক্কা ফিট,নীল জ্যাকেট টা গায়ে দিয়ে, নিজের কাছে নিজেকে সুদর্শন লাগছে।দাম জিজ্ঞেস করলাম ৫০০০টাকা বলে দোকানদার,তখন আমার পকেটে মাত্র ৮০টাকা আছে। এইটাকায় তো জ্যাকেট দিবেনা,দোকানদার কে পরে নিয়ে যাবো বলি,দোকানদার বলে স্টক সিমিত শেষ হয়ে যাবে তারাতাড়ি আসবেন।জ্যাকেট ছেড়ে দোকান থেকে আসতে মন চাইছেনা,খুব ইচ্ছে করছে জ্যাকেট সাথে নিয়ে আসি।

বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়েগেল মা দেখি উঠানে শুকনো পাতা কুড়াই।ছোট বোন বস্তার মুখ খুলে ধরে আছে মা তাতে ডেলে দেয়।আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বলি মা আমাকে একটা জ্যাকেট কিনে দিতে হবে।
আচ্ছা দিবো।
কাল কে টাকা দিতে হবে কিন্তু।
মা শুনে না শুনে ভাব ধরে,
ও মা কি বলি শুনো না।
এইবার সোজা হয়ে দাড়ালো কি বল, আমাকে একটা জ্যাকেট কিনে দিতে হবে আমার বন্ধুরা সবাই নিয়েছে।
মা জানো কি সুন্দর জ্যাকেট,গায়ে দিলে আমাকে রাজপুত্রের মতো লাগবে।বাবা কে বল টাকার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
আমার স্বাদ আহ্লাদ সব মায়ের কাছে বাবার সামনে সামনি হতে একটা ভয় লাগে।
রাতের মা আমাদের ভাই বোনদের খাবার দিলো,বাবা সাথে খেতে বসলো।
আমি মাকে বারবার তাগাদা দিচ্ছি, মা মা মা বলে ইশারা দিচ্ছি বাবাকে জ্যাকেটের টাকা দিতে বলতে।
মা, বাবা কে উদ্দেশ্য করে বলে একটা কথা বলতাম, তখন বাবা মাথা উপর করে, আবুসুফিয়ান একটা জ্যাকেট কিনতে চাই টাকা লাগবে,কত টাকা? ৫০০০টাকা।
বাবার মুখটা মলিন হয়েগেল,ভাত তালায় নাড়ছড়া করে অনেক্ষন, মুখে আর একটি ভাত দেয়নি পানি ডেলে দিয়ে,শার্ট টা গায়ে দিয়ে ঘর থেকে চলে যায়।
মা খুব রাগ করছে সেইদিন, এইবার হলো মানুষ টা সারাদিন ক্ষেতে কাজ করে এখন না খেয়ে চলে গেলো।
সেইরাতে আমাদের কাহারো খাওয়া হয়নি।
রাতে শুয়ে শুয়ে অনেক ভাবলাম বাবার প্রতি খুব মায়া হলো।
সকালে ঘুম থেকে উঠে বালিশ তুলে দেখি টাকা,গুনে দেখি ৫০০০টাকা।আমি তো খুশিতে আত্নহারা মন চাইছে একদৌড়ে গেয়ে নীল জ্যাকেট কিনে নিয়ে আসি গায়ে জড়ায়।

বাজারে গেয়ে নীল জ্যাকেট টি কিনে নিলাম বন্ধুদের সাথে ফটোসেশনে অংশ নিলাম দলবদ্ধ ছবিতে আমি মধ্যস্তলে।সবার মাঝে আমাকে বেশ সুদর্শন লাগছে।
আমাকে এত সুন্দর দেখাচ্ছে ব্যাপার টা আমার বড়লোক বন্ধুরা ভালো ভাবে নেয়নি।তারা কেমন করে আমার পরিচয় বাহির করে নিয়েছে জেনেছে আমি এক বর্গাচাষা কৃষকের ছেলে এতদিন তাদের সাথে বানিয়ে বানিয়ে গল্প করেছি।এখন তারা আমার সাথে মেলামেশা করতে চাইনা,আড্ডায় আমাকে দেখলে উঠে যায়।সবকিছুতে এড়িয়ে চলে।

এই জিনিস টা আমার মনে ভিষণ আঘাত করে,প্রচন্ড ধাক্কা লাগে।আগে কলেজে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকতাম এখন যেতে ইচ্ছে করে না দিন দিন অনিয়মিত হয়ে যাচ্ছি,লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে যাচ্ছে ।এই দিকে বাবা নানা রোগে আক্রান্ত মাঠে আগের মতো কাজ করতে পারেনা ছোট ভাই বোন বড় হচ্ছে তাদের লেখাপড়ার খরচ বরণ পোষণ বাবার একার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।

সিদ্ধান্ত নিলাম বিদেশ চলে যায়,বাবা প্রথমে রাজি হয়নি তার ইচ্ছে আমাকে লেখাপড়া করাবে।সেই ইচ্ছে তার পূরণ হয়নি, ভিটা বন্ধ রেখে মহাজনের কাছ থেকে দুইলাখ টাকা সুদে টাকা নিয়ে বিদেশ চলে আসলাম।

মাসে শেষে যা বেতন পায় দেশে পাঠিয়ে দিই,নিজের খরচের জন্য যে পরিমাণ টাকা হাতে রাখি তাতে মাস শেষে টানাপোড়েন হয়।একদিন আমাদের কাজের জন্য কোম্পানি একটি বিশাল মলে নিয়ে গেয়ে, কাজ শেষ করে ফিরতি পথে ডলে সাজানো একটি জ্যাকেট দেখি,কি সুন্দর ডিজাইন, মাঝখানে চেইনটা সোনালী রংয়ের,মলের নানা রঙ্গের লাইটের আলোতে ঝিক ঝিক করে,আমি ছুটে জ্যাকেট কাছে,গায়ে দিলে আমাকে কেমন দেখাবে তা নিয়ে ভাবতেছি সত্যি কথা কি ওটা আমার এতো বেশি পছন্দ হয়েছে এখন কিনে নিয়ে আসি গায়ে দিই,তখন বেতন পাইনি,আর কয়টা দিন বাকি তখন মাসের পঁচিশ  তারিখ আর পাঁচদিন পর বেতন পাবো তখন কিনে নিবো, মন স্থির করে নিলাম জ্যাকেট টা আমি কিনে নিব।

মাসের পচিঁশ টা দিন গেল আমার তেমন বিরক্তিকর লাগেনি বাকি পাঁচটি দিন এক এক করে গুনেছি, কেন যাচ্ছে না কেন যাচ্ছে না হাইহুতাশ করতাম।বেতন পাওয়ার সাথে আর দেরি করিনি মলে গেয়ে ঐ দোকানে গেলাম দেখি ওটা এখন ডলে মধ্য পড়ে আছে,পিটিং রুমে গেয়ে গায়ে দিয়ে দেখলাম বেশ ভালো মানিয়েছে,গুছিয়ে  কাউন্টারে এনে ক্যাশিয়ার কে দিলাম।
ক্যাশিয়ার বারোশ দেরহাম  চাইলো এইখানে কোন দরদাম নাই,পোষাকের গায়ে যা লেখা তা দিতে হবে।মানি ব্যাকে হাত দিলাম।রারোশত টাকা যখন বাহির করলাম তখন ব্যাগ টা শূন্যে হয়ে গেলো।মনে পড়লো বাড়িতে তো টাকা পাঠাইনি, আমি টাকা পাঠালে ঘর চলে,বাবার অসুধ চলে,ছোট ভাই বোনের লেখাপড়া, মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো আমি যদি বারোশ টাকা দামের জ্যাকেট নিলে, বাড়িতে সবাই উপাস থাকবে।

সেইদিন আমার বালিশের নিচে বাবা টাকা কোথায় থেকে এনে রাখলো?তার কাছে তো কোন জমা টাকা ছিল না।মা কেন সন্ধ্যা হলে ছোট ভাই বোনদের গল্প শুনাবে বলে কেতা নিয়ে শুয়ে যেতো।বাবা মহাজনের কাছে অগ্রিম ধান বিক্রি করে আমার নীল জ্যাকেটের টাকার ব্যবস্থা করে।সেই মৌসুমে ভালো ধান হয়নি, জমির মালিক ধারদেনা পরিশোধ করে বাবার কাছে তেমন টাকা ছিল না, ভাইবোনদের শীতের কাপড় কিনা হয়নি,বাবা পুরানো একটা শাল গায়ে দিয়ে শীত কাটিয়ে দিয়েছে।এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে বুঝে উঠতে পারেনি।ক্যাশিয়ার স্যার স্যার আপনার পেমেন্ট টা আমি টাকা গুলো মানি ব্যাগে ডুকিয়ে রাখি,পরে নিয়ে যাবো বলে জ্যাকেট রেখে চলে আসি।

এই প্রবাস ভোগ নয়,আমায় দায়িত্ব নিতে শিখিয়েছে।


Comments

Popular posts from this blog

একটি মেয়ে দৌড়ে বাসে উঠে বৃষ্টিতে অর্ধেক ভিজে.............

চাটগাঁইয়া ভাষার কবিতা

চাটগাঁইয়া কবিতা....নোয়া পয়সা....